পবিত্র মক্কা মদিনার দিনগুলি: (পর্ব ৭)
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ মুজিবুল হক ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০১:৫০:৫৪ রাত
বাস তো নয় যেন আলিশান বিমান. বাসটি কোন এক কাজে পবিত্র মক্কার দিকে যাচ্ছে এই সুযোগে পয়সাও কামাই করে নিচ্ছে গাড়ী থেকেই দেশে ফোন করে কথা বললাম এর আগে গত তিনদিন ছাড়া প্রতিদিন দেশে কথা বলেছি মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে হোটেলে পৌঁছে গেলাম আমরা এখানে আসার আগেই আমাদের কাফেলা প্রধান জনাব মোহাম্মদ আলী আনসারী সাহেব হোটেলে এসে পবিত্র মিনা হতে আগত হাজী সাহেবানদের খাওয়া দাওয়া ও দেখভালের নির্দেশনা দিয়ে পূনরায় পবিত্র মিনা চলে গেলেন. মাগরিবের নামাজ আদায় করে আমরা চার জন মাথা মুন্ডন করতে বের হলাম. সব সেলুনেই দীর্ঘ লাইন. এখানকার প্রায় সব সেলুনই পাকিস্তানিদের. হাতে গোনা কয়েকটি মিশরীয় সেলুনও আছে. অবশেষে মাথা মুন্ডন করে হোটেলে ফিরে আসলাম. অন্যান্য সময় মাথা মুন্ডন করা ৫ রিয়াল হলেও আজ নিল ২০ রিয়াল বাংলাদেশী মুদ্রায় মাত্র ৪৩০ টাকা. একে একে সবাই গোসল শেষে এহরাম ছেড়ে সাধারণ কাপড় পরিধান করলাম এশার নামাজ পড়ে জেদ্দায় অবস্হানরত ফরিদের ভগ্নিপতির নিয়ে আসা খাবার খাই. ইতিমধ্যে জেদ্দার অদূরে বাহারা নামক স্হান হতে আমার মামাতো বোনের স্বামী সালাহউদ্দিন ও এসে হাজির হয়েছে. অতএব আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে রাত ১২টায় আমরা ফরজ তাওয়াফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হব. ঠিক যথা সময়েই আমরা পবিত্র বায়তুল্লাহর সামনে হাজির হয়ে তাওয়াফ শুরু করি. খুব ভিড় ছিল তবে তা গা সওয়া ব্যাপার হয়ে
গেছে. আমার মামাতো বোনের স্বামী সালাহউদ্দিন আমাদের শিখিয়ে দিল কিভাবে সহজে ও স্বল্প সময়ে তাওয়াফ করা হয় . ফরিদ ইমতিয়াজ ও ইসমাইলরা আলাদা আলাদা ভাবে তাওয়াফ ও সাঁই করে সবাই কোন জায়গায় একত্রিত হব তা বলে দেয়া আছে. এত ভীড়ের মধ্যেও আমরা খুব স্বল্প সময়ে মাত্র ৪০ মিনিটে পবিত্র কাবা তাওয়াফ সম্পন্ন করলাম. পবিত্র কাবা তাওয়াফ করার সময় মহান আল্লাহর কুদরত স্বরূপ যা যা আমাদের চোখে পড়েছে তা প্রকাশ না করে আমাদের মনেই রেখে দিলাম. এরপর সালাতে মাকামে ইব্রাহীম আদায় করে পবিত্র জমজমের পানি পান করে পবিত্র সাফা মারওয়া সাঁই করা সম্পন্ন করি. তাওয়াফ ও সাঁই করা শেষে সম্মানিত হাজী সাহেবান দের চেহারা দেখে মনে হলো এরা মানুষ না বেহেশত থেকে আসা ফেরেশতা. কালো তামাটে ও ফর্সা সকল হাজী সাহেবানদের চেহারা থেকে যেন নূর ঝরে পড়ছিল আমরা অসামান্য পরিতৃপ্ত হয়ে হোটেলে ফিরলাম.একটা বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না. ৭ই জিলহজ্ব ৮ই জিলহজ্ব ও ৯ই জিলহজ্ব এবং আজ ১০ই জিলহজ্ব একটানা চার রাত ও তিন দিন এক সেকেন্ডের জন্যও আমরা কেউ ঘুমাইনি তার উপর ছিল দীর্ঘ সময়ের কষ্টকর গাড়ী ভ্রমণ ও প্রচন্ড ভীড়ের দীর্ঘ পদযাত্রা. এর পরেও ক্লান্তি দূর্বলতা কিংবা বিরক্ত কারো মুখে মনে দেহে একটুও স্পর্শ করতে পারেনি. সুস্থ দেহে সুষ্ঠ ও সূচারু ভাবে হজ্ব সম্পন্ন হওয়ায় মহান আল্লাহর দরবারে অশেষ শুকরিয়া আদায় করে আগামী কাল ও আগামী পরশু অর্থাৎ ১১ই জিলহজ্ব ও ১২ই জিলহজ্ব জামারাহ'য় পাথর নিক্ষেপের কথা মাথায় রেখে ঘুমাতে গেলাম.
আজ ১১ই জিলহজ্ব ২৭শে অক্টোবর ২০১২ শনিবার. আজ জামারাহ'তে পাথর মারার দ্বিতীয় দিন নিয়ম অনুযায়ী আজ বড় মেজ ও ছোট শয়তানের প্রতীকি স্তম্ভে ৭টি করে মোট ২১টি ছুড়তে হবে. রাতে সবারই ভাল ঘুম হয়েছে ফজরের নামাজ পড়ে নাশতা সেরে আবার ঘুমিয়ে পড়ি. সকাল ৯টায় জেগে গোসল সেরে আমরা ৪ জন জামারাহ'র উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই. মসজিদুল হারামের পাশ ঘেষে প্রিয় নবীর ঘরের পাশ দিয়ে পর পর দুটি বিশাল ট্যানেল এর পর আরো দুই কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে জামারাহয় পৌঁছাতে হয়.
জামারাহ'র উদ্দেশ্যে যাত্রা
অন্য সময় এই পথে দ্রত গতিতে যানবাহন চলাচল করলেও ৭ই জিলহজ্ব থেকে ১২ই জিলহজ্ব ৬ দিন সাধারণ যানবাহনের জন্য এই পথে চলাচল বন্ধ থাকে. মসজিদুল হারাম অতিক্রম করার পর ট্যানেলে প্রবেশ করার পর একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল যে গতকাল রাতেই বেশির ভাগ হাজী পবিত্র মিনা হতে পবিত্র মক্কায় চলে এসেছেন আর এই জন্যে জামারাহ'র যাত্রা পথে খুব ভীড় পরিলক্ষিত হচ্ছে ধীর পায়ে হেঁটে যখন জামারাহ'য় পৌঁছালাম তখন বেলা ১টা.
জামারাহ'র পথে হাজীদের ভীড়
আমরা আমাদের পাথর গুলি সুষ্ঠ ও নিরাপদে নিক্ষেপ করে পূনরায় পবিত্র মক্কা দিকে অগ্রসর হওয়ার আগেই ভীড়ের চাপে চার জনেই দলছুট হয়ে গেলাম. খোঁজাখুজি না করে অবশেষে একাই পবিত্র মক্কার দিকে পথ চললাম.
জামারাহয় পাথর নিক্ষেপ
জামারাহ'য় আগত হাজীদের দুটি ধারা দেখা যাচ্ছে একটি ধারা পবিত্র মক্কা হতে এসে পূনরায় পবিত্র মক্কার দিকে চলে এই ধারাতে ভীড় খুব বেশি অপর ধারাটি পবিত্র মিনা হতে এসে পূনরায় পবিত্র মিনায় চলে যাচ্ছে এই ধারাটি খুবই হালকা ভীড় নেই বললেই চলে দুটি ধারার একটির সাথে অপরটির মেশার কোন সুযোগ নেই সম্ভবত কতৃপক্ষ সবকিছু মাথায় রেখেই এই সূচারু পথ নির্দেশনা তৈরি করেছে. আমার অন্যান্য সাথীরা আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বিধায় পবিত্র মসজিদুল হারাম মুখী জনস্রোতের সাথে মিলে আমি পথ চলতে লাগলাম বেশ কিছু পথ আসার পর বুঝতে পারি আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি কোন চিন্তা না করে নিকটবর্তী মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করে নিলাম. এই মসজিদের নাম সম্ভবত "মসজিদে জ্বীনি" অথবা "জ্বীনের মসজিদ" মোবাইল ইনফো মেসেজ এসেছে তাতেই বুঝতে পারলাম এ জায়গাটির নাম "আল ওতাইবিয়া" খুব পানির পিপাসা লেগেছে. কিছুদূর এগোতেই এক লোক হাতে দুটি জুসের প্যাকেট ধরিয়ে দিল. এখন আর অবাক হচ্ছিনা কারন এটি পৃথিবীর এমন বরকত ময় স্হান যেখানে বান্দা আল্লাহর কাছে যেকোন সৎ ইচ্ছা করা মাত্রই পূরণ করেন. রাস্তার পাশে লেখা নির্দিষ্ট পথ ধরে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর পবিত্র মসজিদুল হারামের মিনার নজরে আসে আর আমি যখন হোটেল কক্ষে পৌঁছি তখন আছরের নামাজের সময় হয়ে গেছে আমার সঙ্গীরা পথ হারিয়ে ফেলে তবে সবাই সুস্থ ভাবেই হোটেলে ফিরে আসে.নামাজ শেষে ভাতের বদলে রুটি খেয়ে কিছুক্ষণ পর মসজিদুল হারামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই. আমরা পবিত্র মসজিদুল হারামে মাগরিব ও এশার নামাজ শেষে যখন হোটেলে ফিরে আসছি তখন পথিমধ্যে আমাদের কাফেলার পবিত্র মিনায় রয়ে যাওয়া হাজীদের সাক্ষাত ঘটে তারা কিছুক্ষণ আগে পবিত্র মিনা হতে ফিরে এসে এখন ফরজ তাওয়াফ করার জন্য পবিত্র মসজিদুল হারামে যাচ্ছেন. হোটেলে এসে মায়ের রুমে গিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন আত্মীয় ওনার সাথে দেখা করতে এসেছেন তাদের বিদায় দেয়ার পর কিছুক্ষণ গল্পগুজব শেষে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি..
আগামীকাল ১২ই জিলহজ্ব জামারাহ'তে পাথর ছোড়া শেষে হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে....
বিষয়: বিবিধ
১১৩১ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন